কমল দাশঃ- করোনা-আক্রান্ত পৃথিবী। ভয়ে -আতঙ্কে -অনিশ্চিতায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব ভীত সন্ত্রস্ত। মহামারি ছোবল বসিয়েছে গোটা সভ্যতায়। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। দীর্ঘায়িত হচ্ছে মৃত্যু মিছিল। এমতাবস্থায় আমাদের উদ্বেগ উৎকন্ঠা বাড়ছে ক্রমাগত। অজানা আতঙ্কে প্রহর গুনছে গ্রাম থেকে শহর, ধনী থেকে গরীব। লকডাউনে ঘরে আটকে থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে পড়ছে মন। উদ্বেগ উৎকন্ঠায় আর অনিশ্চয়তায় দৈনন্দিন যাপন যন্ত্রণাদীর্ণ হয়ে উঠছে। মৃত আর আক্রান্তের পরিসংখ্যান দেখতে দেখতে মানসিক চাপ বাড়ছে প্রতিনিয়ত । অজানা আশঙ্কায় বিষিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিনের জীবন। কারো কারো রাতের ঘুমে থাবা বসাচ্ছে অদৃশ্য অনুবীজীর আতঙ্ক। অতিরিক্ত উদ্বেগে কেউ কেউ আবার ঊর্ধ্ব রক্তচাপ, মধুমেহের মত মারন রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না। এক অসহনীয় মানসিক উদ্বেগে আমরা হাঁপিয়ে উঠেছি প্রতিনিয়ত । আত্মীয় পরিজন বন্ধুবান্ধবের সান্নিধ্য না পেতে পেতে সেই অসহনীয়তা আরো বেড়ে চলেছে। আরো কতদিন পর সবকিছু আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে তার অপেক্ষায় আস্থির আমরা। এই উৎকন্ঠিত উৎক্ষিপ্ত প্রতিবেশে থাকতে থাকতে আমাদের মনে অবসাদ বাসা বাঁধছে। জীবনের প্রতি সমস্ত মমত্ববোধ হারিয়ে যাচ্ছে। হতাশা গ্রাস করছে। অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে অনেকেই।
এই অস্থিরতা, উৎকন্ঠা হতাশা অত্যন্ত স্বাভাবিক। যে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি তাতে এই উদ্বেগ অত্যন্ত যথাযথ। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কাছে অসহায় আত্মসমর্পন না করে আমরা চেষ্টা করতে পারি নিজেকে কিছুটা ভালো রাখতে এবং আপনজনকে ভালো থাকতে সাহায্য করতে। সবার প্রথমে আমরা যদি একবার দেখে নিতে পারি করোনা ভাইরাস কোন কোন দিক থেকে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপর্যস্ত করে তুলছে, তাহলে তাকে মোকাবেলার কৌশল খুঁজে পেতে সুবিধা হবে।
Corona virus and mental health
প্রথমত, স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের উৎকন্ঠা অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে আমারা খুবই উদ্বিগ্ব। কোভিডে আমি আক্রান্ত হয়ে পড়ব নাতো- এই চিন্তা আমাদের প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়াচ্ছে। যদি সংক্রামিত হই, তাহলে কিভাবে চিকিৎসা করাব? সামাজিকভাবে কি ধরনের হেনস্তার শিকার হতে হবে? পাড়া প্রতিবেশ,আত্মীয় পরিজনের কাছ থেকেই বা কিরূপ সহযোগিতা পাব? নাকি সামাজিক দূরত্বের নাম করে সামাজিক বয়কটের শিকার হব।
দ্বিতীয়ত, প্রিয় জনের জীবন নিয়ে আমরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আছি। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে ভালোবাসার মানুষটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারা নিয়ে আমাদের ভয় বেড়েছে।
তৃতীয়ত, পথেঘাটে,হাটেবাজারে দেখছি অনেক মানুষ কোনো রকম স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। নিয়ম মেনে মুখোশ পরছে না।পরলেও মুখের পরিবর্তে থুতনিতে শোভা পারছে। এ সমস্ত দেখে আমারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছি। ভেতরে ভেতরে একটা বিরক্তি উৎকন্ঠা আমাদের মনকে ভারি করে তুলছে।
চতুর্থত, আমাদের জীবনের পরিচিত ছন্দ আমূল পাল্টে গেছে। পাল্টে গেছে মানসিকতাও। এখন আমারা ” বাঁচা”র পরিবর্তে” টিকে” থাকায় নিজেদেরকে অভ্যস্ত করে নিয়েছি। “রক্তকরবী” নাটকে বর্ণিত পাথরের কোঠরে তিন হাজার বছর টিকে থাকা ব্যঙের মত আমরাও নিরন্তর টিকে আছি।বেঁচে নেই। ফলে রাজা রূপী করোনার আক্রমণে মরে যাওয়ার ভয়ে আমরা স্বন্ত্রস্ত।
পঞ্চমত, করোনা-ক্লীষ্ট পৃথিবীতে কাজের নিরাপত্তা হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। লকডাউনের কারণে অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়েছে অতর্কিতে। আরো অগণিত মানুষ কাজ খুইয়ে ফেলার আতঙ্কে প্রমাদ গুনছে প্রতিনিয়ত। কেউ কেউ পুরনো কাজ হারিয়ে নতুন কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেছেন। কিন্তু মানিয়ে নিতে পারছেন না। পুরোনো চেনা জীবনটার জন্য তীব্র আফসোস। অনিশ্চয়তাও গ্রাস করছে গোপনে গোপনে। আবার অনেকে কাজ হারিয়ে দিশাহারা। জীবনধারণের পথ খুঁজে পাচ্ছেন না।প্রতিদিন গভীর অনিশ্চিতায় আচ্ছন্ন হচ্ছে মন।
ষষ্ঠত, কিশোরকিশোরীদের জীবনের স্বাভাবিক গতি গেছে হারিয়ে। দীর্ঘদিন বাড়িতে বন্দি।নিজেদের পড়াশোনা নিয়ে, কেরিয়ার নিয়ে কোনো পরিকল্পনা করতে পারছে না। রাজ্য বা দেশের বাইরে গিয়ে যারা পড়াশোনার পরিকল্পনা করেছিল তারা আর বাইরে যাবার উদ্যোগ নিতে সাহস পাচ্ছে না। বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ না থাকায় অস্থির হয়ে উঠেছে মন।
সপ্তমত, আর্থিক নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হয়েছে ভয়ংকর ভাবে। অনেক মানুষের উপার্জন উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছে। করোনা পূর্ববর্তী সময়ে যে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে জীবন কাটাতেন তা রাতারাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ফলে তাঁরা আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
অষ্টমত, সংক্রমণের ভয়ে সামাজিক প্রত্যাহার বেড়ে গেছে বহুগুণ। চেনাশোনা মানুষ অচেনা হয়ে গেছে রাতারাতি। সামাজিক পরিসর থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে স্বেচ্ছা- নির্বাসনে রেখেছি নিজেদেরকে। মনে রাখতে হবে অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষ শারীরিকভাবে দুর্বল। তার বাঘের মত ক্যনাইল দাঁত নেই বা তীক্ষ্ণ নখও নেই যা দিয়ে শত্রুকে আক্রমণ করে আত্মরক্ষা করবে।বড়ো বড়ো লোমও নেই,যা দিয়ে প্রচন্ড শীতের প্রকোপ থেকে নিজেকে বাঁচবে।তার আছে সমাজ। সমাজই তার শক্তি। কিন্তু আজ সামাজিক দূরত্বের আজুহাতে আমরা হারিয়ে ফেলছি যৌথবদ্ধ যাপনের ঐতিহ্যকে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি একে আপরের কাছ থেকে। এর ফলে উদ্বেগ বাড়ছে। বিষন্ন হচ্ছে মন।
নবমত, একাকীত্বের অসহায়তা আমাদের কষ্টকে বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণ। গৃহবন্দী থাকতে থাকতে একাকীত্ব আমাদের গ্রাস করছে গোপনে গোপনে। যৌথ যাপন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে নিজেদেরকে নির্বাসন দিচ্ছি।বলা ভালো দিতে বাধ্য হচ্ছি। এর ফলে মানসিক চাপ বাড়ছে।
দশমত, হতাশার ডুবে থাকছে আমাদের মন। সংক্রমণের দুশ্চিন্তায় এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের তাড়নায় আমরা নিরাশ হয়ে পড়ছি।
আমাদের মধ্যে অনেকেই ইতিমধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানা রকম সমস্যায় জর্জরিত। গৃহবন্দীত্ব আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সেই দিকগুলোকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিকে কি ভাবে মোকাবিলা করা যায় তা নিয়ে আমরা একটু আলোচনা করতে পারি।
১) করোনা সংক্রান্ত সংবাদ ক্রমাগত দেখার ফলে অনেকের মানসিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রথমেই করোনা নিয়ে তৈরি খবরের গল্প দেখা, শোনা বন্ধ করা উচিত। এমন কি সামাজিক মাধ্যমে যে খবর চলাচল করে সেগুলো থেকেও আপাতত বেরিয়ে এলে ভালো হয়। মহামারির খবর বারবার শুনলে আমাদের হতাশা বাড়তে পারে।
২) আমারা শরীরের প্রতি যত্নবান হতে পারি। দীর্ঘশ্বাস গ্রহণ বর্জনের অনুশীলন এবং ধ্যান চর্চা করতে পারি। ছোটোরা এক জায়গায় শান্ত ভাবে বসে চোখ বন্ধ করে কোনো একটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ সংহত করতে পারে।
৪) নিয়মিত শরীর চর্চা অত্যন্ত প্রয়োজন। সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করা বা খোলা চাদে ভ্রমণ মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। বাচ্চারা নাচ, গান, আঁকা বা যেকোনো বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে মনকে সচেত রাখতে পারে। কবিতা, নতুন অভিজ্ঞ, নতুন চিন্তা লিখে ফেলতে পারো। ফোনে ভিডিও কলে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পার। বাবা-মায়ের সাথেও কথা বলতে পারো।পরিমাণ মত ঘুমও সুনিশ্চিত করা খুব জরুরি।
৫) এই পরিস্থিতিতে আ্যলকোহল এবং ড্রাগ শরীর এবং মনের সাংঘাতিক ক্ষতি করতে পারে। ফলে এগুলো ত্যাগ করা উচিত।
৬) কিছুটা সময় নিজেদের বিনোদনের জন্য রাখাটা প্রয়োজন। এমন কিছু কাজ করুন যা আপনাকে আনন্দ দেয়।
৭) মানুষের সঙ্গে কথা বলুন। যারা আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী তাদের কাছে আপনার অনুভূতি বিনিময় করুণ। বাড়ির টুকিটাকি কাজে হাত লাগান। অনেকদিন ধরে ভেবেও যে কাজটা করে উঠতে পারেন নি সেই কাজটা করে ফেলতে পারন। তাতে মন ভালো থাকবে।
৮) নিজের প্রতি যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি বন্ধু এবং পরিবারের যত্ন নিন। এর ফলে মানসিক চাপ মোকাবিলা খানিকটা সহজ হবে।
৯) আপনার কমিউনিটির অন্যান্য সদস্যদের সাধ্যমত সাহায্য করুণ। তাদের চাপ মোকাবিলা করার সহয়তা করুণ। এর ফলে আপনার কমিউনিটি শক্তিশালী হবে।
করোনা আমাদের চেনা জানা পৃথিবীকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। জীবন যাপনের পরিচিত ছক ফিরে আসতে আরো বেশ অনেকটা সময় লাগবে। হয়ত অনেক কিছু আর ফিরে আসবে না। যা নেই বা অদূর ভবিষ্যতে ফিরে আমার সম্ভাবনা নেই তা নিয়ে আপসোস করলে কষ্ট বাড়ে বৈ কমে না। ফলে মনের স্তিতিকে( wellbeing) ঠিক রাখার জন্য নিজেকে পুননির্মাণ করাটা দরকার।নতুন করে গড়ে তোলার অনুশীলন থাকলে আমরা বেঁচে থাকব, ঠিকে থাকব না।
সকল খবর সবার আগে ফেসবুকে ফ্রী পেতে চাইলে আমাদের পেজ লাইক করুন। Click Here..
নতুন করে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তির দাবিতে ডেপুটেশন চাকুরীপ্রার্থীদের!!!