স্বাতী বোলঃ- রাত তখন প্রায় দেড়টা বাজে। শুভব্রত অফিস থেকে ফিরে ঘুমোচ্ছিল অঘোরে৷ সারাদিন অফিসে আজকে অনেকটাই কাজের চাপ ছিল। ফলে আজকে সে তার স্ত্রী নন্দিতাকেও কল করার সময় পায় নি। ক্লান্তির কারণে বাড়িতে এসেও সময় পায় নি কথা বলার।
অন্যদিকে নন্দিতাও কাজে ব্যস্ত ছিল ভীষণ। মাঝরাতে হঠাৎ কিছু একটার শব্দ শুনে ঘুম ভাঙল তার। শুভব্রত আধো আধো ঘুমকাতুরে চোখে নন্দিতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল – কি করছ এত রাতে ?
নন্দিতা কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে বলল – একটা জিনিস খুঁজছি।
শুভব্রত তার উত্তর শুনে আবারও বিরক্ত হয়ে বলল – কি জিনিস খুঁজছ তুমি বল তো ?
নন্দিতা তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে খুঁজে চলল একমনে। শুভব্রত তার কর্মকান্ডে বিরক্ত হয়ে বলল – তোমার জ্বালায় মানুষ একটু ঘুমোতেও পারবে না?
নন্দিতা তার কথার আবারও কোনো উত্তর দিল না। শুভব্রত এবার একটু জোরেই বলল – উত্তরটা তো দিতে হয় কেউ কোনো প্রশ্ন করলে।
নন্দিতা এবার শুভব্রতের দিকে তাকিয়ে বলল – একটা পুতুল খুঁজছিলাম।
তার কথা শুনে একরাশ বিরক্তি সহযোগে হেসে শুভব্রত বলল – পুতুল ? খেপলে নাকি তুমি ? বিয়ে হয়ে গেছে আজকে পাঁচবছর। তোমার বয়সও পঁয়ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। তুমি এখন পুতুল নিয়ে কি করবে ?
নন্দিতা তার বিরক্তি ও কটাক্ষ সহযোগে হাসি দেখে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলল – তুমি ঘুমাও । আমি আলো নিভিয়ে দিচ্ছি ৷
শুভব্রতও সম্মতি জানাল। নন্দিতাও শুয়ে পড়ল তার পাশে ৷ কিন্তু সেই রাতে আর ঘুম এল না তার। চোখের পাতা এক করতে পারছিল না সে কিছুতেই । বুকের ভেতর যেন শোকের ঝড় বয়ে যাচ্ছিল তার। তার মনের কথাগুলো বোঝার মত কেউ ছিল না তার পাশে। তার কষ্ট যেন তাই বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছিল। সে শুভব্রতের পাশে শুয়ে পড়লেও ঘুমোতে পারছিল না কিছুতেই। নন্দিতা তাই আর ঘুমোনোর চেষ্টা না করে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে বসল স্টাডি রুমে। সেখানকার টেবিলের একটি ড্রয়ারে তার একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি লুকিয়ে রেখেছে সে। সেই ডায়েরিটাই বের করে লিখতে আরম্ভ করল আবার নন্দিতা। ডায়েরিটা লিখতে লিখতে পুরোনো সব ঘটনাগুলো চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠল তার।
নন্দিতার তখন সবেমাত্র সাতবছর বয়স। তার দাদার বয়স তখন ছিল চোদ্দ বছর। তার দাদা নান্দনিক ভীষণ ভালোবাসত তার একমাত্র বোনকে। স্কুল থেকে ফেরার সময় এমন একটা দিনও ছিল না যেদিন সে খালি হাতে ফিরত। সে স্কুলে যাওয়ার সময় যা পকেট মানি পেত তা দিয়ে নিজে না খেয়ে নন্দিতার জন্যে কিছু না কিছু কিনে আনত। নন্দিতাও খুব খুশি হত তা দেখে। মা বাবা হারা মাসির কাছে বেড়ে ওঠা দুই ভাইবোন যেন ছিল একে অন্যের পরিপূরক। বেশ কেটে যাচ্ছিল তাদের দিন। একদিন নান্দনিক স্থির করেছিল এবার আর স্কুল থেকে ফেরার সময় সে তার বোনের জন্যে বেশি করে চকোলেট বা আইস্ক্রিম না এনে অল্প করে এসব এনে সে টাকা জমাবে। সেই জমানো টাকা দিয়েই সে তার বোনকে কিনে দেবে উপহার। অন্যথা হয় নি তার।
প্রায় একমাসের পকেটমানি সঞ্চয় করে নন্দিতার সাতবছরের জন্মদিনে নান্দনিক তাকে কিনে দিয়েছিল একটা পুতুল। দাদার দেওয়া প্রথম উপহার বলে সেই উপহারটা কোনোদিনও সে আলাদা করে নি নিজের থেকে। বুকে আগলে রাখত সে সবটা সময়। যদিও বা এরপরেও নান্দনিক অনেক উপহার দিয়েছিল তাকে। কিন্তু সবচেয়ে প্রিয় ছিল তার কাছে এই পুতুলটা। নন্দিতা যখন হোস্টেলে গিয়েছিল তখনও এই পুতুলটাই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল সে। অবশ্য সে জানত না হোস্টেল থেকে ফিরে দাদাকেই আর দেখতে পাবে না। নান্দনিক তার বাড়ি ফেরার আগেই এক পথদূর্ঘটনায় নিহয় হয়। তখন থেকে নন্দিতা যেন আরো বেশি যত্নশীলা হয়ে উঠেছিল এই পুতুলটার ওপরে। পুতুলটাকে সঙ্গে রাখলে তার মনে হত তার দাদা যেন সঙ্গে আছে তার।এতগুলো বছরে একটা দিনও তা কাছ ছাড়া হয়নি নন্দিতার। কিন্তু আজ পুতুলটা হারিয়ে যাওয়ায় তার মনে হতে লাগল তার দাদাই যেন হারিয়ে গেল চিরতরে তার জীবন থেকে।
ডায়েরি লিখতে লিখতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল তার চোখ। আধো ঘুম জড়ানো চোখে ডায়েরিটা সে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে বেরিয়ে এল সেই রুম থেকে। আবারও বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল নন্দিতা। সে লক্ষ্য করে নি এতক্ষণ শুভব্রত অনুসরণ করছিল তার কর্মকান্ড। সে একটু ঘুমিয়ে পড়া মাত্রই শুভব্রত স্টাডি রুমে ঢুকে আলতো হাতে ড্রয়ার থেকে ডায়েরিটা বের করে পড়তে লাগল মোবাইলের আলোয়। নান্দনিকের ব্যপারে আগে জানত না সে। অথবা বলাবাহুল্য জানতে দেওয়া হয়নি তাকে।
নান্দনিককে হারিয়ে নন্দিতা ডিপ্রেশানে ভোগায় তাকে নিতে হত অ্যান্টি ডিপ্রেসিভ মেডিসিন। সেকারণে ডাক্তারের পরমার্শে নান্দনিকের সকল স্মৃতি সরিয়ে দেওয়া হয় ঘর থেকে। কিন্তু কেউ জানত না একটা পুতুল আজও আছে নন্দিতার কাছে। ভাইবোনের এমন বাঁধন দেখে চোখ ছলছল করে উঠল শুভব্রতের। সে নন্দিতার কাছে পুতুলটিকে দেখেছে বহুবার। বিরক্তও হয়েছে তার এই কর্মকান্ডে। সে কোনো এক অজানা কারণেই সহ্য করতে পারত না পুতুলটাকে। নন্দিতাকে ভীষণ ন্যাকা মনে হত তার। এতগুলো বছর সে সুযোগ খুঁজছিল পুতুলটাকে ফেলে দেওয়ার জন্যে। কিন্তু সুযোগ আসে নি। আজ সকালে সেই সুযোগ পেয়ে সে পুতুলটাকে ফেলে এসেছিল ডাস্টবিনে। কিন্তু পুতুলটার সত্যতা জেনে নিজেলে বড্ড অপরাধী মনে হল তার। সে চুপিসারে ঘর থেকে বেরিয়ে পা বাড়াল ডাস্টবিনের দিকে। অবশেষে ডাস্টবিনে ফেলা পুতুলটা কুড়িয়ে এনে তাকে ধুঁয়ে পরিষ্কার করে শুঁকিয়ে সে রাখল নন্দিতার মাথার কাছে।
পরের দিন সকালে নন্দিতার ঘুম ভাঙামাত্রই পুতুলটাকে তার মাথার কাছে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরল সে। তার চোখে মুখে ফুটে উঠল একরাশ আনন্দ। সে শুভব্রতের দিকে তাকিয়ে একরাশ আনন্দিত কন্ঠে বলল – শুভ দেখো কান্ড পুতুলটা মাথার কাছে ছিল। আর আমি সারা বাড়ি মাথায় তুলেছি।
শুভব্রত হাসল তার কথা শুনে। নন্দিতা ছোট্ট শিশুর মত আনন্দে লাফিয়ে উঠল। তার হাসির ঝলক দেখে মন ভরে গেল শুভব্রতেরও। তার মনে হতে লাগল এই পৃথিবীতে এই হাসির থেকে নিষ্পাপ হাসি বোধ হয় আর কিছুই হতে পারে না। নন্দিতার খুশিতে সামিল হল আজ সেও।
সকল খবর সবার আগে ফেসবুকে ফ্রী পেতে চাইলে আমাদের পেজ লাইক করুন। Click Here..
নথি জাল করে কলেজে চাকরি ! অভিযোগের তীর SACT অধ্যাপকের বিরুদ্ধে !