কমল দাশঃ- বাবা নির্মাণকর্মী। মায়ের স্বাস্থ্য দপ্তরের অস্থায়ী কাজ। ছেলে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া। বয়স বারো-তেরো। কলকাতার বাঁশদ্রোনীর একটি স্কুলের ছাত্র। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ। অন লাইনে ক্লাস চলছিল। ছেলেকে মোবাইল দিয়ে বাবা বেরিয়েছিলের মাকে অফিসে পৌঁছে দিতে। মাত্র আধ ঘন্টা। তারমধ্যে সব শেষ। ক্লাস চলাকালীন পাশের ঘরে গিয়ে সিলিং ফ্যানে গলায় দড়ি দিয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়। পাশে মোবাইলে ক্লাস চলছে।
Why is it important to open a school?
বাকরুদ্ধ করে দেওয়ার মত ঘটনা। অসহায় বাবা- মা। নিদারুন যন্ত্রণায় কাতর। সন্তানের আত্মহননের আশঙ্কাও তাঁরা আনুমান করতে পারেননি। আমরা যারা শিক্ষাদানের সঙ্গে যুক্ত তারাও অংশত বিমূঢ়। বোঝার চেষ্টা করছি কিভাবে অতটুকু মনে জমল এতো অন্ধকার? জানি না। তবে একটু বলতে পারি স্কুলে যেতে পারলে, বন্ধুদের সঙ্গে অনুভূতি বিনিময় করতে পারলে, দরদী শিক্ষকের সমানুভূতির পরশ পাওয়ার সুযোগ থাকলে হয়ত এরকম মর্মান্তিক পথ বেছে নিতে হত না। আসলে স্কুল তো শুধু বিদ্যা চর্চার জায়গা নয়, অনুভূতিক এবং সামাজিক বিকাশের আদর্শ পরিসর। অন্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কৌশল, কঠিন সমস্যা মোকাবিলা করার উপায় সহপাঠীদের সঙ্গে সাবলীল মেলামেশায় আয়ত্ত করে নেওয়ার সুযোগ থাকে। নিজের জীবনের জটিল পরিস্থিতি প্রিয় বন্ধু বা মাস্টারমশাইকে বলে সমাধানের পথ খুঁজে নিতে পারে কখনও কখনও। বিষন্নতা বা মন খারাপ অনেকটা প্রশমিত হয় বন্ধুর সাহচর্যে। পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন, সহপাঠীকে দেখে প্রতিকূলতাকে জয় করার বিকল্প দৃষ্টান্ত তাদেরকে অনুপ্রেরণিত করে। সর্বপরি অবিভাবকতুল্য শিক্ষিকা- শিক্ষকদের পরিচর্যা এবং স্নেহ- স্পর্শ ছাত্রদের রূপান্তরের সুযোগ করে দেয়। মনের ভেতর জমে থাকা ক্লেদ- কালিমা ধূয়ে মুছে যায় মাস্টারমশাইয়ের সামান্য প্রশ্রয় পেলে।
করোনা আবহে স্কুল বন্ধ। বাড়িতে বন্দী শিক্ষার্থীরা। নিষেধের বেড়াজালে তাদের প্রাণ হাফিয়ে উঠেছে। বন্ধুর সঙ্গে সামনাসামনি দেখা করার সুযোগ নেই। আড্ডা, মজা, দুষ্টুমি সব অতীত। কতদিনে শেষ হবে অতিমারির প্রকোপ তা তাদের আজানা। কোনো পরিকল্পনা করে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। উদ্বেগ তো জমাট বাঁধবেই মনে। রাগও হওয়া স্বাভাবিক। অসহ্য উৎকন্ঠা-রাগ বেরিয়ে আসতে না পেরে আসাদের জন্ম নিচ্ছে শিশু মনে। তারমধ্যে আগে থেকেই যাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা রয়েছে তাদের অবস্থা আরো দুর্বিষহ। উপরন্তু কেউ কেউ পারিবারিক সংঘাতসহ আরো অসংখ্য জটিলতার মধ্যে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। এমতাবস্থায় স্কুল ছাত্রছাত্রীদের কাছে একটা স্বস্তির জায়গা। ভালো লাগার পরিসর।
ছাত্রছাত্রীদের এই মানসিক সংকটের কথা মাথায় রেখে এবং পাঠদানের কাজকে সচল রাখার জন্য কিছু শিক্ষক ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছাত্রছাত্রী কাছে সশরীরে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। রাজ্যের বিভিন্ন জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন “শিক্ষা আলোচনা”র অনেক শিক্ষক বিদ্যালয়ের কাছাকাছি কোনো ফাঁকা জায়গায় ছাত্রদের ডেকে এনে স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখে তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। প্রয়োজনে পাঠ দান করছেন। অনেকেই সন্ধেবেলায় পৌঁছে যাচ্ছেন ছাত্রের বাড়ি। সমাধান করে দিচ্ছেন জটিল অংক। কেউ কেউ আবার পাঠ্য বিষয়কে নাট্যরূপ দিয়ে ছাত্রের দিয়ে অভিনয় করিয়ে নিচ্ছেন গ্রামের কোনো খোলামেলা জায়গায়। এভাবে তাঁরা চেষ্টা করছেন ছাত্রদের কাছে পৌঁছে যেতে। কিন্তু সবাই তা পারচ্ছেন না। ইচ্ছে ষোলোয়ানা থাকলেও দূরত্বের কারণে পৌঁছাতে পারছেন না।
মাধ্যমিক এবং উচ্ছ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের একটা বড়ো অংশ কর্মক্ষেত্রে থেকে কয়েকশ কিলোমিটার দূরে বসবাস করেন।ফলে লকডাইনের কারণে ট্টেন বন্ধ থাকায় স্কুলে যাওয়াটাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে ছাত্রদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনাটা অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে হয়ত অনেক কুঁড়িকে ঝরে যেতে দেখতে হবে আমাদের ।সরকারের উচিত সমস্ত রকম স্বাস্থ্যবিধি মেনে ছাত্রদের স্কুল ফিরিয়ে দেওয়া। আর এর জন্য প্রথমেই প্রয়োজন শিক্ষকদের কাছাকাছি বদলির সুযোগ দিয়ে ছাত্রদের কাছে সহজে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা।
সকল খবর সবার আগে ফেসবুকে ফ্রী পেতে চাইলে আমাদের পেজ লাইক করুন। Click Here..
করোনা ভাইরাস এবং মানসিক স্বাস্থ্য – লেখক কমল দাশ
Important information